ফ্যাক্টঃআয়নার সামনে দাঁড়ালে আপনি দাঁড়ালে যেমন নিজেকে দেখতে পাবেন, ঠিক তেমনি একটি দেশের মিডিয়ায় চোখ লাগালে সে দেশের অবস্থা অনুধাবন করা সম্ভব। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে চোখ বুলালে এই থিওরিটা মনে হয়না পুরোটা খাটবে। একটা সময় ছিল কিছুদিন আগেও, যখন মিডিয়া বিরোধিদলের ভুমিকা পালন করত। বর্তমানে সেটা নেই। বরং সংবাদ মাধ্যমের কিছু বাস্তব বৈপরিত্য উঠে এসেছে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়। আগেও দেখা গেছে ফটোশপ ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি, সংখ্যালঘু ইস্যুকে সামনে এনে জাতিকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে।
এইসব অপকর্মের পেছনে একটা কারণ হয়তো(!) কাগজের মিডিয়ার কাটতি কমে গিয়ে তাদের ঘাটতি চলে এসেছে। সেটা হলো খবরের মান। আজকাল অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের সংখ্যা এত বেশি যে সেটা লক্ষ্যণীয় একটা ব্যাপার। আশংকার ব্যপার হলো খবরের মান ভাল হবে এমন কিছু জাতীয় পত্রিকার অনলাইন সংষ্করনে হরদমই অপাংক্তেয় খবর দিয়ে নিজেদের খবরের জায়গাটুকু পূরণ করার চেষ্টায় রত থাকে। সে যাইহোক, মিডিয়ার দায়িত্বজ্ঞান, পেশাদারিত্ব আংশিক মুল্যায়নের জন্য আমার আজকের প্রচেষ্টা।
ফ্যাক্টঃ চট্রগ্রামে অ্যামোনিয়া গ্যাসে বায়ু-দূষণ!
বেশিরভাগ পত্রিকার হেডলাইন ছিল এইরকম- [ ব্রেকিং নিউজ- চট্রগ্রাম গ্যাস লিকেজ! শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাস!]
দায়িত্বশীল এইসকল সংবাদ মাধ্যমের খবরে লিকেজ শব্দটা খুব ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। অথচ প্রকৃত ঘটনা হলো গ্যাসের ঐ বিশাল ট্যাংকটি বিস্ফোরিত হয়ে দুরে পতিত হয়েছিল। আর সেই গ্যাস বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু মিডিয়া কোন প্রকার যাচাই বাছাই না করে এই ব্যাপারে নিউজ করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করেছে। এই ব্যাপারটা মিডিয়ার পেশাদারিত্বে ও দায়িত্বশীলতার একটা ছাপ ভালভাবেই চোখে পড়েছে।
ফ্যাক্টঃ ভারত থেকে আসা বুনো হাতি!
আসুন আমাদের প্রথম সারির কয়েকটি মিডিয়ার শিরোনামগুলো পড়ি।
✍ শিকল ছিঁড়ে পালালো হাতি, আবারো অচেতন করা হয়েছে
✍ 'বঙ্গবাহাদুর'কে ঘিরে উৎসবের আমেজ
✍ শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হচ্ছে হাতিটিকে
✍ শেষ পর্যন্ত অজ্ঞান করে ধরা হলো ভারতীয় হাতিটি
✍ হাতি উদ্ধার করতে হবে বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞদের
✍ বুনো হাতিটিকে বাগ মানাতে পোষা হাতি দিয়ে চেষ্টা
✍ বুনো হাতিটিকে না নিয়েই ফিরে যাচ্ছে ভারতীয় দল
✍ ‘বঙ্গ বাহাদুরকে’ বশ করতে তিনটি হাতি
✍ সেই হাতি ধরতে এবার ফাঁদ
✍ বাঁধন ছিঁড়ে জলাশয়ে হাতিটি!
✍ হুঁশ ফিরেছে হাতিটির, উঠে দাঁড়িয়েছে
✍ হাতি উদ্ধার ঘিরে যা হলো...
✍ চেতনানাশক দেওয়ার পর পানিতে পড়েছে হাতিটি
✍ অচেতন হাতিকে টেনে তুলল জনতা
.......
৮৮'র বন্যায় মিডিয়া জনসাধারণের দুর্ভোগ যেভাবে তুলে ধরেছিল, ২০০৪ এ যেভাবে বন্যার ক্ষতি তুলে ধরা হয়েছিল, আমরা এবার তা দেখিনি। অন্য সময়েও এইরকম টুকটাক ব্যতিক্রমি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এইগুলো স্থান পেত ছোট্ট করে ভেতরের পাতায় এক কলামে। কিন্তু প্রথম আলোর নেতৃত্বে, বিবিসি বাংলাসহ দ্বায়িত্বশীল মিডিয়া যেরকম নির্লজ্জ তামাশা করলো সেটা ভেবে অবাক হতে হয়।
অথচ এই সময়ে বন্যাদুর্গত মানুষেরা রাস্তায় জায়গা না পেয়ে স্কুলের ছাদে কিংবা টিনের চালে আশ্রয় নিয়ে কত দূর্বিষহ জীবন যাপন করেছে সেটা তাদের লাইম লাইটে নিয়ে আসেনি। বন্যার সময় মেয়েদের কিছু সমস্যা হয় সেগুলো নিয়ে সচেতনতামূলক সংবাদ করা হয়নি। বন্যায় সরকারের লোকেরা পদক্ষেপ নিয়েছে কি-না প্রশাসন কি করেছে, ইউনিয়ন পরিষদ কোন জনবিরোধী কাজ করলো কি-না, গম চুরি হয়েছে কি-না সেসব ব্লার করে দিয়ে ফোকাস করেছে একটা হাতি!!
ফ্যাক্টঃ হিরো আলম
(সমকাল)
“হিরো আলম কে? কোথায় তার আবাস? পড়াশোনা কতটুকু? এসব প্রশ্নের জবাব এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই পাওয়া যায়। তাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছে কোনও কোনও পত্রিকা। টেলিভিশন-চ্যানেল তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তার সঙ্গে ছবি তুলে অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। আর হিরো আলমকে নিয়ে ফেসবুক ফান অ্যাপসও তৈরি হয়েছে। তাতে হিরো আলমের ‘পরবর্তী সিনেমায়’ কে কোন ভূমিকায় অভিনয় করবেন তা জানা যাচ্ছে। এই অ্যাপস দিয়ে নিজের ভূমিকা নির্ধারণ করে তা ফেসবুকে পোস্টও দিচ্ছেন অনেকে। ফেসবুকে হিরো আলম লিখে সার্চ দিলেই পাওয়া যাচ্ছে তার এবং তাকে নিয়ে নানা কাজের খবর।”
একটি বহুল প্রচারিত অনলাইন গণমাধ্যমের একটা খবরের টুকরো অংশ এটা। আমরা দেখেছি অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এই ব্যাপারটা নিয়ে নিজেদের অনলাইন পাতা ভরে রেখেছে।
প্রকৃতপক্ষে খবর হিসেবে নয়, নিছক তামাশা আকারে এরা হিরো আলমকে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছিল যেটা মোটেও পেশাদ্বারিত্বের আওতায় পড়ে না। তাকে উপস্থাপনে যেভাবে নিজেদের হীনমন্যতা প্রকাশ পেয়েছে সেটা ভাবতেও অবাক লাগে।
ফ্যাক্টঃ গুলশান রেস্তোরা প্রসংগ
গুলশানে পথভ্রান্ত জংগীরা যখন আক্রমণ করে জিম্মিদের হত্যা করছে তখন একটি শীর্ষস্থানীয় চ্যানেলে খবর প্রচার করা হয় বাথরুম থেকে একজন জিম্মি যোগাযোগ করেছে তাকে উদ্ধারে সাহায্য করার জন্য। বাকি চ্যানেলগুলোও আর কম যাবে কি করে? তারা তথ্য অনবরত দিতে থাকেন যে কখন কোন ফোর্স কি ওয়েপনস নিয়ে আক্রমণে আসছে। কি স্টেপ নিয়েছে, কতজন জনবল নিয়ে তারা আসছে, কতজন আহত, নিহত হয়েছেন। এইসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো নিজেদের পেশাদারিত্বের ও দ্বায়িত্বজ্ঞানের চরম নজির স্থাপন করে!!
ফ্যাক্টঃ ফালতু নিউজ ও সেক্স নিয়ে বাড়াবাড়ি!!
# পুরুষদের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রাকৃতিক উপায়
# কমে যাচ্ছে দম্পতিদের যৌন ক্ষমতা, করণীয় জেনে নিন!
# বয়ঃসন্ধি লজ্জ্বার নয়, বরং শেখার
# পুরুষের যৌনশক্তি বৃদ্ধিতে রসুনের ব্যবহার
# যেসব খাবার যৌনশক্তি বাড়ায়
# পুরুষের যৌন সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ৭টি সহজলভ্য খাবার
# কি খেলে যৌন শক্তি বৃদ্ধি হয়
# যৌন শক্তি বাড়ানোর উপায় কি
# পুরুষের স্বাস্থ্য সমস্যা ও সমাধান
আমাদের অনলাইন মিডিয়াগুলোর স্বাস্থ্য/লাইফস্টাইল কলামগুলো এমনভাবে টিপস দেওয়া শুরু করেছে যেন বাংলাদেশের পুরুষদের ভয়াবহ ব্যাধি রয়েছে যা নিরাময়ে তাদের আন্তরিকতা সীমাহীন!!! স্বনামধন্য জাতীয় মিডিয়াগুলো নিজেদের দ্বায়িত্ব যেন বেমালুম ভুলে গেছে। ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা এইসব আজেবাজে নিউজ করে নিজেদের টিআরপি বাড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে। অথচ এতে যে প্রতিষ্টানের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে সেদিকে খেয়াল কই?
তাহলে আমাদের মিডিয়া কি নিয়ে ব্যস্ত থাকা উচিত?
হ্যাঁ, এতকিছুর পর অবশ্যই এটা না লিখলে অন্যায় করা হবে। মিডিয়ার কাজ কী? এই প্রশ্নের বহু উত্তর পাওয়া যাবে তন্মৈধ্যে জনগণকে রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে আপডেট রাখাকে মুল কাজ বলেই ধরে নেওয়া হয়। জনসাধারণের মধ্যে যারা শিক্ষিত কেবল তাদের কাছেই মিডিয়া যায় এবং সর্বস্তরের মানুষের কাছে ধীরে ধীরে সেটা পৌছে।
ধরা যাক বাল্যবিবাহ নিয়ে একটি ঘটনা ঘটল। সেটা সাংবাদিক পত্রিকায় নিউজ করার সময় ঐ এলাকায় বাল্যবিবাহের একটা পরিসংখ্যান সংক্ষেপে তুলে ধরতে পারেন। যা সচরাচর এখন পাওয়া যায় না।
বড় কোন প্রকল্প হোক সেটা সেতু বা অন্য কোন উন্নয়ন কর্ম সেটা তুলে ধরাই মিডিয়ার কাজ নয়। সেখানে কত টাকা অর্থায়ন করা হলো, কত টাকা ব্যয় হলো, কিভাবে কাজে ফাঁকি দেওয়া হলো, কোন উপায়ে দুর্নিতি হলো সেটা তুলে ধরাই হলো মিডিয়ার সার্থকতা।
দেশের জনগণকে তথ্যের সরবরাহ করে সচেতন রাখা আমি মনে করি মিডিয়ার সবচেয়ে জরুরী কাজ। সাংবাদিকরা দলভিত্তিক সাংবাদিকতা করতে দেখা যায় যা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জন্য ভাল কোন ফল বয়ে আনা দূরের কথা ঐ দলেরই ক্ষতি করে থাকে। সাগর রুনি হত্যার বিচার দাবীতেও আমরা সাংবাদিকদের এক প্লাটফর্মে পাই না। পত্রিকা/চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের হস্তক্ষেপের কোন ঐক্য আমরা লক্ষ্য করিনি। বাংলামেইল অনলাইনের উপর সরকারের অপারেশনকে অন্য চ্যানেলগুলো কিংবা পত্রিকাগুলো তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কয়েকদিন আগে বসুন্ধরায় আগুন লেগে যাবার পর বিটিভির নীতির মতোই বাংলানিউজে কোন নিউজ আসেনি।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে আমাদের মিডিয়া ঠিক পথে হাঁটছে না। ভারত পাকিস্তানের দিকে নজর কমিয়ে দেশের সমস্যাগুলো আরো প্রকটভাবে তুলে ধরে সেটা সরকার/প্রশাসনের নজরে না আনলে সেটা মোটেও সংবাদমাধ্যমের সার্থকতা নয়।
শুধু সমস্যা তুলে ধরলে হবে না। এর সম্ভাব্য সমাধানও মিডিয়ায় তুলে ধরতে হবে। রাজনৈতিক যে অসম পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেটার ভবিষ্যৎ কী, কোথায় চলেছে স্বদেশ এগুলো নিয়ে গবেষণা করতে হবে। দেশের সম্পদ কোথায় কোথায় অকাজে পড়ে আছে এবং সেটা কিভাবে কাজে লাগানো যায় সে ব্যপারে সরকারকে অবহিত করতে মিডিয়াই ভূমিকা পালন করতে পারে।
পরিবেশ দূষণ, দ্যারিদ্রতা, চোরাকারবারী, পাচার সমস্যা এগুলো নিয়ে সরেজমিনে অভিজ্ঞতা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করুক না। এগুলোই তো তাদের কাজ। কোথাকার কোন নায়ক, নায়িকা, সেক্স সিম্বল হয়েছে, কোথায় নায়িকা পাদ মেরেছে, কোথায় গিয়ে কি ফালাইছে, কখন ঐ বলিউডে ছবি মুক্তি পাবে, অমুক দেশের কোন জায়গায় সাতটা বাচ্চা হয়েছে এইসব না খুঁজে বাস্তবধর্মী দ্বায়িত্বশীল সাংবাদিকতাই প্রত্যাশা করি আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে।
সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশে এখন কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নেই। যে কোন দাবি নিয়ে সরকারের সামনে দাঁড়ালে পুলিশ দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সাহস করে রাজনৈতিক দল তো মাঠেই নামতে পারছে না তার ওপর যদি মিডিয়া নিজেই সরকারের সেবাদাস হয়ে জনগণের মনোযোগ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে জনস্বার্থ আদায়ে বিঘ্ন ঘটায় তাহলে এই জনপদের শেষরক্ষা কোনভাবেই হবে না। জনদাবিকে সামনে তুলে ধরতে মিডিয়াকেই সবচেয়ে বড় দ্বায়িত্ব নিতে হবে। রামপালের মতো জঘন্য পরিকল্প বন্ধ করতে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হতে হলে মিডিয়াই হোক আমাদের চালিকাশক্তি!!
(ধৈর্য নিয়ে এই পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ রইল। তার সাথে একটা আবেদন করছি- মিডিয়ার লোকদের সজাগ করতে আপনি নিজের অবস্থান থেকে লিখুন। কিংবা শেয়ার করুন মিডিয়াকে নিয়ে সমালোচনামূলক লেখাগুলো। এই সময়ে মিডিয়ার ওপর ভর করেই আমাদের পথ চলতে হবে।)
0 টি তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন