চাচা কাহিনীঃ কোরবানীর গরু (রম্য)



আমার এক ফ্রেন্ড আছে যার নামটা যতটা স্মার্ট কাজটা ততখানিই আনস্মার্ট । তাঁর বাবার সর্বমোট ১৩ টি জীবিত ছেলেমেয়ে আর যদি না মরত তাহলে তো মাশাল্লা ১৭ টিই থাকত । যাক ব্যাপার সেটা না । আমি তো তাদের এবারের কুরবানীর গরু কিনবার কথাই লিখছি ।

রাজি । তাঁর একমাত্র বাবাকে নিয়ে প্রায়ই ঝামেলায় পড়ে যায় । বেচারার মান সম্মানের দিকে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ করবার দরকার হয়না চাচার । দুমধাম যেইটা করবার, বলবার দরকার বলে ফেলেন অথবা করে ফেলেন। এইতো কুরবানির গরু কেনা নিয়ে ভয়াবহ কিছু ঘটনার সম্মুখিন হতে হল আমার গোলগাল বন্ধুটির ।

রাজির বাবা সোবহান চাচা বরাবরই দেশীয় মাল পছন্দ করেন । এইবারও তার কোন ব্যতয় হবে সেটা খামাখা কে ভাবতে যাবে । রাজির মনে মনে ইচ্ছে কোনমতে একটা গরু পছন্দ করে ফেললেই ল্যাটা চুকে যায় । কিন্তু চাচার কাহিনী তো এক মহাভারত । এক একেক জায়গায় গিয়ে একেক প্রকার কাহিনী করে ফেলবেন যে কেউ যদি সবগুলো নোট করে তবে আরেকটা নিউ চাচা কাহিনী না হবার জোঁ নেই ।

হাটে গিয়েই সবচেয়ে শুকনোমতন একটা গরুর দিকে চাচার নজর পড়ল । রাজিও মনে সন্দেহ করেছিল এইটারেই তাঁর বাবার নজরে লাগবো । চাচা তাঁর নীল রঙের পাঞ্জাবীর সাথে পড়েছেন একখানি বার্মিজ লুঙি । লুঙিটা ভাজ ভাজ হয়ে তাঁর পয়সার দীনতার পরিচয় বেশ ভালভাবেই জানান দিচ্ছিল সেইদিকে উনার নজর কই । গরু বিক্রেতা বেচারা বোধহয় খুব সম্ভবত আশা করছিল একজন স্মার্ট ক্রেতার আর সেই কারনেই চাচার দিকে সে না তাকানোর ভান করে মোবাইলে টেপাটেপি শুরু করে দিল ।

রাজির বাবা এক নজর লোকটাকে দেখলেন । পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই । রাজির মনে সন্দেহ হয় তার বাবার পান চিবুনি আর গরুর জাবর কাটার মধ্যে বিশেষ কোন তফাৎ আছে কি না।

রাজি কোনকিছু বলে না। সে মিনমিনে উপায়ে কোনমতে খালি বদমেজাজি বাবার দিকে তাকায় । দেখি বাবা কি করেন । বাবা যখন লোকটার মনোযোগ আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হলেন তখন খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললেন । "এই গরু কি আদাম(মালিকহীন)"
লোকটা অপছন্দ করুক আর যা-ই করুক বিক্রি করবার জন্যই তো আসছে । তাই তার প্যান্টের পকেটে টুপ করে মোবাইলটা রেখে রাজির বাবার দিকে ফিরে বলল "গরুর মালিক আমিই । গরু দেখছেন আপনে?"
- না দেখছি । কত হইলে দিবেন ?
- একদাম কমু না দামাদামির দর কমু ।
- পয়লা একদামই কও ।
- না । দাম একটাই কওয়া লাগবো । কন কোনটা কমু ।
- এই পুলা । তর বয়স কত?
- গরু কিনবার আইছেন না জামাই দেখবার আইছেন চাচা?

চাচা প্রশ্নের এই উত্তরের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না । খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন । এক পা পিছুও সরে আসলেন ।
- আইজকালকার পোলারা এত বেয়াদপ হয় চিন্তাও করছিলাম না । যাক এই গরু আর নিমুই না ।
- ও চাচা । রাগ করলেন? আরে দামটা তো হুনি যান,,,

চাচার আর দাম শুনবার মতো মুরোদ নাই । রাজিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বিড়বিড় করলেন - "লুঙির কাছায় পয়সা আছে সমিস্যা কি । গরু তো কিনমুই । লোকের কাছে ছোট হয়ে গরু কিনবার কি দরকার?"

অগত্যা রাজিও পিছু পিছু হাঁটা ধরল । চাচা গিয়ে দাঁড়ালেন বেশ কয়েক গজ দুরে আরেকটা শুকনো খড়খড়ে দেশি গরুর কাছে । এইবার আর নিচু হয়ে দেখা দেখি করলেন না । তবে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন । অনেকটাই শহরের মোড়ল চাচা যেভাবে গরু দেখেন সেইরকম ব্যাপার । কিন্তু চাচার লুঙিপরাটা রসিক প্রকারের লোকদের অল্প স্বল্প কৌতুক গ্রহণ থেকে বিরত রাখার উপায় ছিল না ।

- হেই গরুর দাম কত ।
- একদাম ছিষট্টিহাজার দুইশ ।
- এত দাম কেন ? মোটের ওপর মাংস কয় কেজি হইবো দেখছ বেটা?
- ৫০-৬০ কেজি ।
- মাথা কারাপ মিয়ার বেটা? ৩০-৪০ হইবো কিনা আমার সন্দেহ আছে ।
- তাইলে আপনে নিবেন কেন? অন্যখানে যান। ঘ্যানান গিয়া। আমার এত ট্যাখা পড়ছে না গরু বেচবার।
" আইজকাইলকার পোলাপানরা এইরুম খাটাইস্যা হইলো কেন যে আল্লায়ই জানে " ।

--<
সবচেয়ে বড় কথা হইল ঐদিন চাচা আর গরু কিনতেই পারলেন না । শুধু শুধু গরু বেপারী অথবা গরুর মালিকদের নিকট অপমানিত হলেন অথবা অপমানিত করলেন । আর আমার বন্ধুর কথা কি আর বলব সে তো ভেতরে ভেতরে খালি গজগজ করল । তাছাড়া আর কিইবা করার আছে ।
কিন্তু কোরবানী তো দিতেই হবে । চাচা দু-একটা গালও না দিয়ে ছাড় দিলেন না নিরীহ রাজি-কে । সে একেবারে হাবার মতো কেন দাঁড়িয়ে থাকবে । তার কি কোনই দায়িত্ব নেই? সে বড় ছেলে হিসেবে কোনদিনই সঠিক কোন কাজে আসতে পারল না । চাচা পোড়া কপাল হিসেবে নিজের কপালে দু-এক ঘা আলতো থাপ্পড় দিতেও বাকি রাখলেন না ।

যাই হোক পরের দিন চাচা তাঁর চিরায়ত পরিচ্ছেদে আবার গরু ক্রয়ের অভিযানে বের হলেন । কয়েকটা গাল দিয়ে রাজিকেও বের করলেন । বেচারা অগত্যা একটা লম্বা দড়ি নিয়া মাথা নিচু করে বাধ্য ছেলের মতো বাপের পিছু পিছু হাঁটল ।
হাটে যাবার আগেই নাদুস নুদুস একটা গরু অথচ একেবারে দেশি গরূর মতই তার হাবভাব দেখে রাজির বাবার বেশ আগ্রহ জন্মাল । গরুটির বয়স বেশি না । 
- এই ব্যাটা খাড়া না । গরুটা দেহি ।

চারদিকে ঘুরেফিরে কোমরে হাত দিয়ে চাচা দেখলেন । আর মুখের দাঁড়িতে হালকা হালকা হাত বোলাতে বোলাতে বললেন ।
- দেশি গরু তো নিশ্চিত । তো কত দাম চাও ।
- চাচা ৪৫ হলে ছেড়ে দিমু ।

চাচার তো জিহবায় পানিই চলে আসল । তা বোধহয় লোকটা টেরপেয়ে খানিকটা আফসোসও করছে ।
- নিবেন নাকি হাটে যামু । কন ।
- এই ব্যাটা তোর এতো তাড়া কিসের । আইচ্চা । ৩৮ দিমু দিলে দে আর টাকা নে ।
- না চাচা একদাম । 

চাচা আর কিছু না বলে হা করে দাঁড়িয়ে থাকা রাজিকে একটা কষে চড় দিয়ে পানের ফিক ফেলতে ফেলতে শাসালেন ।"হা করে দাঁড়িয়ে থাকো না? হাবামিপনা তোর যাবুই না? বলদা কোথাকার ।"
চাচার নিরুদ্বেগ হাটা দেখে গরুর মালিক ডাক দিল । "এই যে চাচা । ৪০ হবে?"
চাচার অভিনয়টা বেশ ভালই কাজে লেগেছে । তিনি যেন চান্স পাইলে এখনি একটা ড্যান্স দেন এই আরকি। শেষমেষ টাকাপয়সার লেনদেন শেষ হলে চাচাকে লোকটা বেশ সাবধান করে দিল । গরুটি বেশ খেপাটে । যদি চান্স পায় তবে যারে পাইবো তারেই ঢুস দিয়ে পলাইতে চাইব । চাচা ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন বলে কেউই মনে করতে পারলো না । চাচাই প্রথমে দড়িটা হাতে তুলে নিলেন । গরুটাও যেন বাধ্য ছাত্রের ন্যায় উনার সাথে চলতে থাকল ।
বেচারা রাজি অন্যান্য বারের ঈদের গরু কিনবার ন্যায় এবারকার গরুতেও একটা বেত নিয়ে গরুর পিছু পিছু হাটতে থাকল । বাড়ির কাছাকাছি আসামাত্রই আবার গরু হম্বিতম্বি শুরু করে দিল । অবস্থা বেগতিক দেখে রাজিদের এক জমিতেই একটা খুঁটিতে গরুটাকে কোনক্রমে বেঁধে ফেললেন । এরপর চাচা বটগাছের ছায়ায় আরাম করে বসে চাচাদের খবর দিতে রাজিকে পাঠিয়ে দিলেন ।
বাড়ি মাত্র কয়েক কদম দুরে । অতএব আবাল বৃদ্ধবনিতা সবাই মিলে বড়বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ঈদের আগের দিন কুরবানির গরু দেখতে জমায়েত হতে থাকলেন । নানাজনে নানামত । অতএব রাজি ও তাদের পরিবার বিশেষত রাজির মা ও ছোটচাচা গরুটি মোড়ল চাচার গরু থেকে একহাত এগিয়ে থাকবে সেইটা প্রমাণ করবার জন্য বেশ কয়েকটি গ্রহণযোগ্য আর্গুমেন্ট হাজির না করে ছাড়লেন না ।
যাই হোক মাগরেবের নামাজের পর স্বাভাবিকভাবেই গরুকে বাড়ির ভেতরে আনবার তাগিদ অনুভুত হলো । চাচা মোগরেবের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে বসেই ফরমান জারি করলেন হাবিব(উনার ছোটভাই একই সাথে রাজির ছোটচাচা) ও রাজি যেয়ে যেন গরুকে এনে বারান্দায় বেঁধে রাখে ।
রাজি ছোটচাচাকে ডেকে কর্মব্যাস্ত হয়ে পড়ল বাড়ির যত ছোট বাচ্চাকাচ্চা আছে গরু থেকে তারা যাতে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান সংহত রাখে । ডেকে হেঁকে বাচ্চাদের সাবধান করাতে বরং উল্টোটাই ঘটল । বাচ্চারা পড়াশুনা বা অন্যান্য কাজকর্ম বাদ দিয়ে গরুকে বারান্দায় আনার মহড়া দেখতে তারা খবর পেল আর হুড়োহুড়ি করে আসা শুরু করলো ।
যাক গরুর কাছে গিয়ে রাজি নিতান্তই অন্যান্যবারের মত "হ্যাঁপপ, পেঁপঁপপ, প্যাঁপ, পাঁপ" শব্দের সহিত গরুকে পোষ মানাবার চেষ্টা করলো । গরুটাও অনেকটা প্রবোধ গিললো মনে হলো । তাঁরা দুজন বারান্দার কাছ পর্যন্ত আসল যদিও গরুটা গরুদের মতই হেঁচড়ামো করছিল ।
মহা বিপত্তিটা ঘটলো বারান্দায় তুলবার সময় । ৩ ফুট ঊঁচু সিঁড়ি বেয়ে গরু বেচারা কোনমতেই উঠতে রাজি না । ৫-১০ মিনিটেও যখন এই দুজন নাকাল বান্দা পারলো না তখন অকর্মার ঢেঁকি বলে হাঁক ছেড়ে ভেতর ঘর থেকে চাচা পিঠ খুঁচাতে খুঁচাতে আসলেন বারান্দায় ।

গরুটার মনে এই ছিল কে জানত । দু দুটো ১০-১২ বছরের বাচ্চাকে মাটিতে ফেলে রাজির নিতম্বে সপাটে একটা গুঁতো দিয়ে পাগলা গরুটি মুহুর্তের মধ্যে কোনদিকে যে উধাও হয়ে গেল কেউই ধারণাই করতে পারল না । চাচা খালি দাঁত কিড়মিড় খেতে লাগলেন । তেমন কিছু বলতেও পারছেন না কারন গরুটি তার হাতে দড়ি থাকার সময়ই পগার পার হয়েছে ।

বাড়ির মহিলারা হা-হুতাশ করতে থাকলেন । কেউ কেউ খোঁজার জন্যও বের হলেন । রাজি পাছার ব্যথা নিয়েও টর্চ নিয়ে ছোটচাচাকে নিয়ে বের হলো । ধানের ক্ষেত পার হয়ে বিল ঝিল সব জায়গা দেখা হলো । সাথে গ্রামের অন্যান্য ইয়াং ছেলেপুলেরাও খোঁজল । কিন্তু গরুটি কেউই খুঁজে বের করতে সক্ষম হল না ।





ঈদের দিন বিষন্ন মনে সবাই ঘুম থেকে জাগলো । সবারই মনে অনেক বড়কিছু হারিয়ে ফেলার দুঃখ কাজ করছে । রাজির মা তো কান্নাকাটি করছেন সেই ভোরবেলাতেই । সকালবেলা চাচাও বেশ মন খারাপ অবস্থায় বসে থাকলেন ।

তবে খানিক পর যখন ফর্সা হয়ে গেছে তখন চাচা কি মনে করে বাড়ির পেঁছনের বাঁশঝাঁড়ের দিকে গেলেন । ফিরলেন লঙ্কারাজ্য জয়ের মতো । রাজি তার বাবার হম্বিতম্বি দেখে তো আবেগে কাইন্দা শেষ । চাচাও ব্যাপক বীরত্বের সাথে বাঁশঝাড়ে আটকে যাওয়া মাটিময় লাল রঙের গরুটি উদ্ধার করে রাজি সহ সবার কাছ থেকে বাহবা কুড়ানোর খায়েশে উঠোনে বাঁধছেন কুরবানির গরু ।
Share on Google Plus

গেম চেঞ্জার

বাংলাদেশ কে নিয়ে খালি স্বপ্ন দেখি না টুকটাক কাজও করি । মূলত যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ এক সত্ত্বা। ছড়া, কাব্য, গল্পে, ছবি, ভ্রমণে, বিশ্লেষণেও নিজেকে খুঁজে ফিরি।
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 টি তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন