রুজি একটি নষ্টা মেয়ে


মিরপুর থানায় আজ শেষ বিকেলে বেশ ভিড়। দেশের প্রায় সবকটা টিভি চ্যানেল, জাতীয় দৈনিক, নাম না জানা রেডিও, অনলাইন মিডিয়া সাংবাদিকরা গাড়িতে করে, বাইকে করে, রিক্সায় এমনকি পাশ থেকে হেঁটে হেঁটেও অনেকে মিরপুর থানার দিকে এক রকমের প্রতিযোগিতামূলক দৌড়ে আসছেন। হরেক রকমের ক্যামেরা, এইচডিএমআই ক্যামকর্ডার, স্ট্যান্ড আরো কত কি অতএব লাইভ টেলিকাস্ট হবার ব্যাপক সম্ভাবনা যে রয়েছে সেটা ঢের আশা করা যায়।
এছাড়াও মানবাধিকার কমিশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এইচআরসি, অধিকারের কর্মীরাও চলে এসেছেন সেটা তাঁদের গলায় ঝুলানো আইডি কার্ডটা দেখলেই নিঃসন্দেহ হওয়া যায়।
থানার ফার্স্ট ফ্লোরের সামনের মেঝেতে একটা টেবিল। দূর থেকে দেখে যতদূর বোঝা যায় কিছু গানের সিডি ও বইপত্র। দু-তিনজন প্রৌঢ় বয়সের পুলিশ এগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে কি যেন বের করছে আর একটা সাদা পেজে লিখছে। নির্দিষ্ট দু-একজন সাংবাদিক ছাড়া যে কারোর জন্য এই টেবিলের কাছে আসতে বারণ। বাকি সাংবাদিকরা তাই একটু দুরে অপেক্ষা করছেন। থানার অফিসার ইনচার্জের ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তাঁদের যে যতটুকু জানেন ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে যাওয়া রুজি নামের একটি মেয়ের ভাইরাল হয়ে যাওয়া ভিডিও নিয়ে তাঁরা আলাপ করতে থাকলেন।
সাংবাদিক ও সোসাইটির লোকদের অপেক্ষার পালা বেশিক্ষণ দীর্ঘ হয়নি। অসি ইমতিয়াজ ফারুককে দ্রুত পায়ে দেখা যাচ্ছে থানার হাজতের দিকে এগুতে। তিনি ফিরে আসলেন পেছনে একটা কিশোরী মেয়ে ও কিশোর-তরুন একটি ছেলেকে নিয়ে। যতদুর জানা গেল তিনি নিজেই মিডিয়ার সাথে কথা বলবেন।

মিডিয়ার বিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ বয়সে তরুন ছেলেমেয়েরা দেখলেন যে দুজন অপরাধীকে ধরে আনা হয়েছে তাদের উভয়েরই বয়স ২০-২২ এর নিচে। মেয়েটার বয়স তো ১৫র বেশী হতেই পারে না। মেয়েটার মুখের কালো দাগ বুঝাচ্ছে চড় থাপ্পড় ভালই পড়েছে অথচ ছেলেটার গালে কোনও আচড় নেই। তাকেও অবশ্য বেশ ভীত মনে হল।
অপ্রাপ্ত বয়স্কা এই মেয়েটির নাম রুজি। রুজি মনে করেছিল ঘটনার বিস্তৃতি থানা পর্যন্তই শেষ। আর বাড়বে না। যদিও পুলিশ ভ্যানে আসার সময় তার মন খুব করে বলছিল এই খারাপ সময়টা বেশিক্ষণ তাঁর জীবনে থাকবে না। শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তব যে বড়ই নির্মম। তাঁর দয়া মায়া কিছুই নেই। সে চিন্তাও করেনি কোনও দিন অপরাধী হয়ে মিডিয়ার সামনে এক-রকমের চিড়িয়াখানার প্রাণি হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অথচ আজ সে এই নির্মম বাস্তবতার শিকার।
তবে এখনো রুজির মন সাহস দিচ্ছে তেমন কিছুই হবে না। খালি নিজে ঠিক থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বনের বাঘে খাইবার আগে মনের বাঘেই খায়া ফালায় লজিকটাই বারবার মনে হতে থাকল রুজির।
অতএব এই সময়ে আল্লাহকে ডেকে পরিত্রাণের আশা করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকতে পারে অবুঝ মেয়েটা সেটা বের করতে পারেনি। যদিও রুজি মন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিল মাথাটা ঠান্ডা রেখেই সব পরিস্থিতি সামলাতে হবে।

মিডিয়ার কর্মীরা আজকের প্রাণিদের দেখে অন্যান্য দিনের চেয়ে অন্তত একটু বেশিই উৎসুক হয়েছিলেন কারন অনেকটাই আজব শ্রেণির প্রাণি বলতেই হয় এদেরকে। স্বাভাবিকের চেয়ে বড়সড় সাদা দড়ি দিয়ে দুজনেরই কোমড় বাঁধা; অবশ্য দুরত্ব বজায় রেখেই। একজন পুলিশ সবার সামনে বলেই বসলেন ঐ ছেলেটাকে, আমাদের কথামত বলবা; স্যারের কথার মাঝখানে কথা বলবা না। ওসি একটা ছাপানো কাগজ হাতে নিয়ে তেলাওয়াত করা শুরু করলেন -

"এই মেয়েটি সমাজের একটা নষ্ট অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। ঘটনা বেশি কিছু না আবার অনেক কিছুই। ব্যাবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি শামীম সাহেবের ছেলে পাভেলের সাথে এই মেয়েটা রিলেশন করতে চেয়েছিল। অনেকদিন ধরেই চেস্টা করছিল। পরে ছেলেটা রাজি না হওয়াতে ক্ষিপ্ত হয়ে আজই বেলা ২.৩০ টার দিকে ওর মুখে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করে বসে। অবশ্য পরে আমাদের টিম অভিযান চালিয়ে হাতে নাতে একটা ছেলের সাথে নষ্টামিতে ধরা পড়েছে। ঐ ছেলের সাথে সম্পর্ক করে টাকা পয়সা নেয় নিয়মিত। আমরা তারও প্রমানসহ ধরেছি ওদের।
...
উদ্ধার করা সিডির মধ্যে বেশ কয়েকটা পর্নোগ্রাফিক সিডি, জিহাদী বই রয়েছে। আপনারা নিজেই দেখতে পারেন টেবিলেই আছে।"


রুজি মেয়েটা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মাথা তো ঠান্ডা রাখা দুরে থাক, একেকটা অপবাদ যেন পারলে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ওসির একেকটা কটুবাক্য যে সুঁচকাঁটা হয়ে তার বুকে ক্রমাগত বিঁধছে লোকটা যেন একদম ওয়াকিবহাল নয়। এখন সে কি করবে। মিথ্যাচারের যে সীমা সম্পর্কে এই মেয়েটা জানত আজ সেই সীমা লঙ্গিত হয়ে পেরিয়ে গেছি দূরে, মিলিয়ে গেছে বহু দূরের দিগন্তে। সে এখন জানেনা কোথায় মিথ্যাচারের শেষ হওয়া সম্ভব।

থানার দিকে মৃদু গরম হাওয়া বইছে, ছিমছাম পরিবেশ, একরকমের পিনপতন নিরবতা। ওসি স্যার ইচ্ছেমত কলংকারোপ করলেন। মেয়েটার ওপর, ছেলেটার ওপরও। দুজনের কেউই মুখ ফুটে কিছু বলতে সাহস করল না পাছে চড় থাপ্পড় খেতে হয় ভদ্রসমাজের এতগুলো মানুষের সামনে। তবে টিনএজার এই মেয়েটার চেহারায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছেন আইন ও সালিশের কর্মী মেহজাবীন শিরিন। তিনি স্তভিত হয়ে ওসির দেয়া অপবাদগুলি শুনছিলেন আর মেয়েটার প্রতিক্রিয়াসমূহ এক মনযোগে লক্ষ্য করছিলেন।

এখন সাংবাদিকদের পালা। মেহজাবীন তাঁর মেদ ও স্বাস্থ্যবান দেহ ঠেলে মোটামুটি সামনে এলেন ভিকটিম মেয়েটির সামনেই, যাতে ওর সাথে কথা বলা যায়। উনার ভারী দেহের সামনে যে কেউই কাঁচুমাচু খেতে বাধ্য। আরেকটা ব্যাপার বলা যায় উনার ভাবমূর্তি নিয়ে, উনার ভেতরের ব্যাক্তিত্বটিই যেন উনার দেহের সাহায্যে প্রকাশ পেতে চাইছে।
যাইহোক কোনপ্রকার ভনিতা না করে তিনি মেয়েটিকে প্রথমেই প্রশ্ন করলেন -তুমি তো শুনলা সব অভিযোগ। তোমার প্রতি যে যে অভিযোগ আনা হলো তুমি কি এগুলো করো? এই বয়সেই?
রুজির উচিত ছিল একটা প্রতিবাদমূলক প্রতিক্রিয়া দেখানো যে, এইসব অভিযোগের নামে যা বলা হয়েছে এগুলো সব মিথ্যা, শুধুই অপবাদ, সবই মিথ্যা রটনা। কিন্তু সে কি বলবে হতবুদ্ধি হয়ে গেল নিজের মধ্যেই। রুজি মাথায় অক্সিজেনের অভাব বোধ করল। মনে হলো পৃথিবীটা বুঝি আজ থেকে আর ঘুরবে না। এখানেই কিয়ামত হয়ে যাবে। ওর মাথায় কোনকিছু ধরছে না কি বলবে। তাঁর কান্না পাচ্ছে। ভীষন কান্না। চেপে রাখা কান্নাজড়িত কন্ঠেই বলল-
> উঁ...মি--থ্যে--- কথা। সব মিথ্যে--- উঁ উঁ।

টিনএজার এই মেয়েটা যে, পারছে না তাঁর মানসিক দৃঢ়তা ধরে রাখতে, সেটা বুঝবার সাধ্য হারিয়ে ফেলেছেন উপস্থিত এখানকার মিডিয়া কর্মীদের প্রায় সবাই-ই। অলরেডি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁতে শুরু করেছে। যদিও প্রথমে কান্নার শব্দগুলোর তীব্রতা কম ছিল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই সেটা অনেক ডেসিবেল বেড়ে গেল।
উপস্থিত সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মীর বেশিরভাগই মেয়েটি ছলনা করছে কি-না সেটা নিয়ে নিতান্তই সন্দেহভরা দৃষ্টি নিয়ে ওঁর দিকে ভ্রু কুঁচকে, অনেকেই হেলাফেলার দৃষ্টিতে তাকালেন।
চুপ নষ্টা মেয়ে বলে রুজির পাশ থেকে এক সিভিল ড্রেসের অফিসার ধমকে ওঠলেন। মেয়েটার অনেকটা কানের কাছে গিয়েই ধমকটি দিলেন বড় গোঁফওয়ালা এই অফিসার।
অগত্যা এবার সাংবাদিকরা ছেলেটিকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। কিন্তু সবাইকে থামিয়ে দিয়ে জুনিয়র এক সাংবাদিককে দিয়েই শুরু করাতে চাইলেন ওসি ইমতিয়াজ।
তবে যে প্রশ্নগুলো লোকটা করছে সেগুলো লেখা তাই বোধহয় আগেই প্রশ্নগুলি তৈরি করে রেখেছে যাতে ভূলে না যায়।

< তোমার কি নাম?
> রাজিন ইকরাব।
< ঐ মেয়ের সাথে তোমার কি কোন সম্পর্ক আছে?
> জি। আছে।
< কতদিন যাবত।
> অনেকদিন যাবত।
< ওকে টাকা পয়সা দিতা?
> না। ইয়ে.. হ্যাঁ। হ্যাঁ।


রুজি থেমেছিল। আবারো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করল। এরপর অঝোরে গলায়।
উপস্থিত প্রায় সবাই ছি ছি রব শুরু করলেন। এই রকম নষ্টা মেয়েরে বাবা। ছিঃ। কেবল একজন মহিলা সাংবাদিক হাত তুললেন আপত্তি আছে বলে। তিনি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন
- এই মেয়ে তুমি কি ছেলেদের সাথে সময় কাটাও?
রুজি মাথা নাড়ালো। অনেকটাই সামনে পেছনে।
প্রবীণ সাংবাদিক শ্যামসুন্দর সাহা আর দেরি না করে গট গট করে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় খালি বলে গেলেন - কলিযুগ। কলিযুগ। নষ্ট মেয়েকে নিয়ে কি বাহারি কৌতুহল। ছিহঃ ছিঃ
দু একজন ছাড়া আর কারোরই সন্দেহ থাকলো না রুজি একটি নষ্ট মেয়ে।



আজকালকার সাংবাদিকরাও স্মার্ট। এতই স্মার্ট যে সম্মেলন শেষ হবার ঘোষনার আগেই নেটে আপলোড করা শুরু করলেন।
থ্রিজি নেটের সুবাদে ছড়িয়ে পড়লো এই সম্মেলনের ভিডিও ইউটিউবে, ফেসবুকে, অনলাইনে। শেয়ারের ওপর শেয়ারে সন্ধ্যার আগেই বাংলাদেশ পেরিয়ে প্রবাসে দুর দুরান্তের দেশগুলিতে, দুনিয়ার ওপর-পিঠে পৌঁছে নানান রকমের অনুভূতিতে নাড়া দিতে থাকল এই ব্রেকিং নিউজ। ১ ঘন্টার মধ্যে হিটের ওপর হিট হতে থাকল জাতীয় অনলাইন পত্রিকাসমুহে।
শুধু আজকের সম্মেলনের ভিডিও না, বিকেলের ছুরি দিয়ে মুখে কোপ দেয়ার দৃশ্যটি বরং এটিই বেশি বেশি আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হল। অনেকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রিপ্লে করে দেখলো কোপানোর নৃশংস দৃশ্য।
রুজি এখন পর্যন্ত পুরো ভিডিওটি না দেখলে কি হবে ওর বন্ধুরা ঠিকই দেখেছে এবং আফসোসও করছে কিন্তু কে এই গড্ডালিকা প্রবাহে দাঁড়িয়ে বলবে "রুজি নয় ভিলেন পাবেল"।
স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই কথা বলার মত কোন দুঃসাহসী বন্ধু রুজির ছিলনা। কেউ ছিল না। রুজি অন্ধের মতো হাতড়িয়ে দেখল কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই।

এই ঘটনার সংবাদমূল্য যে কত বেশি তা প্রফেশনাল সাংবাদিকরা ভালই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই পরের দিন বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের পেছনের পাতায় এমনকি কোনটাতে ১ম পাতায় রঙিন ছবিতে বড় বড় হেডলাইন হলো এই সাংবাদিক সম্মেলনের মেয়েটি। এইসব রুজিদের কারা এই নষ্ট পথে আনছে সেটা বের করতে অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরি হতে থাকল। কেউ কেউ দেখতে থাকলেন এর পেছনে ভারতীয় সিনেমার হাত, কেউ কেউ দেখলেন আকাশ সংষ্কৃতির ফল, কেউ ইন্টারনেটের, এমনকি কেউ কেউ দেখলেন জামাত বিএনপির হাতও। বিভিন্ন স্যাটেলাইট টিভিতে প্রদর্শিত সাংবাদিক সম্মেলনের চুম্বকীয় অংশ নষ্টা মেয়ের ছলনাময়ী কান্নায় রং চং মাখিয়ে পরিবেশন করা হতে থাকল। সারা দেশে একটা ভালই আলোড়ন সৃষ্টি হল। সাধারণ জনগণ বিশেষত ইয়াং ছেলেপুলেরা নষ্টা মেয়ের কান্নার অভিনয়ে বিনোদিত হতে থাকলেন।


আগের পর্বসমূহঃ
রুজির বাসায় পুলিশ
রুজি ও একটা বখাটের গল্প
{যদিও প্রচলিত ধারণার সিরিজ গল্প বলতে আমি রাজি নই। একেকটা পর্ব আলাদা আলাদা একেকটা গল্পই ভাবতে পারেন।} 

পাদটিকাঃ
ফ্রাংক ডিক্সি'র (ইংরেজ চিত্রশিল্পি) আঁকা ছবি Lady the saffron shawl ১ম ছবি
২য় ছবিটি গুগল থেকে নেয়া
http://www.somewhereinblog.net/blog/gameChanger/30075775
Share on Google Plus

গেম চেঞ্জার

বাংলাদেশ কে নিয়ে খালি স্বপ্ন দেখি না টুকটাক কাজও করি । মূলত যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ এক সত্ত্বা। ছড়া, কাব্য, গল্পে, ছবি, ভ্রমণে, বিশ্লেষণেও নিজেকে খুঁজে ফিরি।
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 টি তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন