মানবসভ্যতার আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়াঃ পঞ্চম মাত্রার স্টোরেজ মিডিয়া ☺ ☺ সামান্য একটি কয়েনেই ৩৬০ টেরাবাইট ডাটা ধারণ :-



✒ আচ্ছা! আপনি বলেন তো, পৃথিবীর বয়স কত? আর মহাবিশ্বের বয়স?
সঠিক টা জানলে নিশ্চয়ই বলতেন যে, মহাবিশ্বের বয়স হচ্ছে ১৩.৮২ বিলিয়ন বছর। আর পৃথিবীর মাত্র ৪.৫৩৪ বছর। সর্বশেষের আগে যে স্টোরেজ মিডিয়া আবিষ্কার করা ছিল সেটাতেই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। ঐটা কি ছিল জানেন? কোয়ার্টজের তৈরি গ্লাস স্টোরেজ যেটার আয়ু ছিল ৩০০ মিলিয়ন বছর (মানে ৩০ কোটি বছর)।
আর ভাই, মানুষ বাঁচে কয়দিন বলেন তো? মাত্র তো ৬০ বছর কি ৮০ বছর। বড়জোর ১৫০ বছর। এখন তার তথ্যগুলো যদি সে রেখে যেতে চায় তবে কয়বছর যথেষ্ট?
আমার মতে তো ১০ হাজার বছরই যথেষ্ট। কিন্তু এইসব বিজ্ঞানীদের মনে হয় খেয়েদেয়ে কাজ নাই। ;) তাঁরা নিত্যনতুন তাক লাগানো সব উপহার দিয়েই চলেছেন।

ঠাসকি খাওয়ার মতো ব্যাপারটি শুনেন এখন, সর্বশেষ যেই স্টোরেজ মিডিয়া উনারা বানিয়েছেন সেটার স্থায়িত্ব মহাবিশ্বের বয়সের চেয়েও বেশি। ১৪ বিলিয়ন বছর। হুঁ। B:-) 
আমি তো এটাকে চিরস্থায়ী বলতে এক পায়ে খাঁড়া। কি বলেন আপনারা? হাহ??

✒ আসল কথা হলোঃ
ব্রিটিশদের ইউনি "University of Southampton" এর Optoelectronics Research Centre (ORC) গবেষণা টিম একটি নতুন ডাটা ফরম্যাট নিয়ে কাজ করেছে। বিষয়টা একটু খুলেই বলি, কৌশলটি হলো, গ্লাসের মধ্যেই তথ্যকে ন্যানোস্ট্রাকচারে পরিণতে করে রেখে দেয়া। আর স্ট্যান্ডার্ড সাইজের ডিস্কে এই তথ্য রাখতে চাইলে সর্বোচ্চ ৩৬০ টেরাবাইট ডাটা রাখা সম্ভব। যেখানে আমাদের ল্যাপটপে স্টোরেজ থাকে মাত্র ৫০০/৭৫০/১০০০ জিবি।

জানেন নিশ্চয়ই, ১০২৪ জিবি/গিগাবাইট = ১টেরাবাইট। তাহলে আমার যে, ল্যাপটপ (৭৫০জিবি) সেইরকম কয়টি ল্যাপটপের তথ্য ধারণ ক্ষমতা ঐ ডিস্কটি পাচ্ছে? বলেন তো?

অবাক হলেও হতে পারেন, ১৮৯°C ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও ডিস্কের কোন ক্ষতি হবে না। যেখানে ১০০°C তাপে পানি ফুটতে থাকে। হাঃ হাঃ হাঃ এবার বুঝুন ঠ্যালা। :)



✒ পাঁচ মাত্রার স্টোরেজ ডিস্ক
একটি সাধারণ সিডি থেকে যখন তথ্য পড়া হয়(মানে সিস্টেমেটিক রিড করে) তখন যেটা হয় সেটা হলো, অতি ক্ষুদ্র একটি রেখা বরাবর লেজার রশ্মি নিক্ষেপিত হয়। ফলে রশ্মির প্রতিসরণ হয় আর বাইনারি ১ অথবা ০ তথ্য হিসেবে পাওয়া সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে মাত্র দুইটি মাত্রা(ডাইমেনশন) থাকে (অন ও অফ)। আর এই ডিস্কেই কিন্তু আমরা রাখতে পারছি ছবি, গান, চলচ্চিত্র, সফটওয়্যার, ডকুমেন্ট সবকিছুই।
পাঁচ মাত্রার বেলায় তথ্য সংরক্ষিত হবে নিতান্তই পাতলা স্ট্রাকচারে যেটাকে ন্যানোগ্রাটিংস বলা হয়। ২ মাত্রার ডিস্কের ন্যায় এখানেও আলো প্রতিসরণ ব্যবহার করে তথ্য যাচাই করে নেয়া হয়। তবে একটা ব্যবধান আছে। ব্যবধানটা হলো এনকোডিং এর জায়গাটায়। এখানে মনে করতে পারেন, পাঁচবার এনকোড করে তথ্য লেখা ও পড়া হয় যা দ্বিমাত্রিক ডিস্কে মাত্র ২-বার করা হয়।
অবাক হচ্ছেন? কৌশলটা আসলে পাল্টে ফেলা হয়েছে। আলোর প্রতিসরিত রশ্মি পদার্থবিদ্যার নিয়মানুযায়ী X, Y ও Z অক্ষরেখা বরাবর ইতিমধ্যেই সে তিনটি মাত্রা অর্জন করে ফেলেছে। আর বাকি দুটো মাত্রা হিসেবে রাখা হয়েছে- ন্যানোগ্রাটিংসে অবস্থান, প্রতিসরিত রশ্মির দিক বা Birefringence।
এই ডিস্কে চরম দ্রুতগতির লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে, অতি সুক্ষ অথচ সুতীব্র কম্পাংকের রশ্মির সাহায্যে তথ্য ধারণ ও পড়া হবে। আর তথ্য লেখার সময় ন্যানোস্ট্রাকচারের বিন্দুতে তিনটি লেয়ারে রাখা হবে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে একই বিন্দুতে তিনটি ভিন্ন বিট তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে। এই বিন্দু তথা ডটের দুরত্ব হবে মাত্র ৫ মাইক্রোমিটার।
জানেন কি? ১ মাইক্রোমিটার = ১ মিটারের ১০ লাখ ভাগের ১ ভাগ। আর ১ মিটার কতটুকু সেটা নিশ্চয়ই জানেন? ;)
এই যে দেখুন ল্যাবে এই প্রযুক্তি কিভাবে তথ্য পড়ছে কিভাবে-



অকল্পনীয় এই প্রযুক্তি কাজ করতে পারবে মোটামুটি এভাবে-
ন্যানোস্ট্রাকচার স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলোর দিক পরিবর্তন করে তথ্য বিনিময় করবে বিশেষ ঐ কাঁচের মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে সমাবর্তনের পরিবর্তনটি অবশ্যই গুরুত্বপুর্ণ। এটা করতে অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপ প্রযুক্তি ও একটি সমাবর্তক যন্ত্র থাকবে।

সিলিকন একটি মৌলিক পদার্থ যেটি বিগলিত করতে উচ্চমাত্রার তাপ ও চাপ প্রয়োগ করতে হয়। আর রাসায়নিকভাবে এর স্থায়িত্বও অনেক। গবেষকরা তো বলেই দিয়েছেন, সর্বোচ্চ ১০০০°C পর্যন্ত এই ডিস্ক নিরাপদ। B-) অতএব আর চিন্তা কিসের?

✒ যুগান্তকারী এই প্রযুক্তি
মানব সভ্যতার অগ্রগতির একটি মাইলফলক হিসেবে ২০১৩ সালে এই নতুন দ্বার খুলে যায় যখন, ৩০০কিলোবাইটের একটি টেক্সট ফাইল সফলভাবে পাঁচমাত্রার গ্লাস-ডিস্কে সংরক্ষণ করা সম্বব হয়। একে বর্তমানে ডাকা হচ্ছে "Superman memory crystal"।
গবেষকরা বর্তমানে এটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে দিতে চাচ্ছেন, আর এ লক্ষ্যে ব্যবসায়িক পার্টনারও খোঁজা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। তবে তাঁরা ইতিমধ্যেই মানব সভ্যতার ইতিহাসের কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ দলিল রেকর্ড করে রেখে দিয়েছেন এই যুগান্তকারী আবিষ্কারে। এগুলো হল-
✍ জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার
✍ নিউটনের অপটিক্স
✍ ম্যাগনা কার্টা
✍ কিং জেমস এর বাইবেল



এটা করা হয়েছে এ কারণে যে, মানব সভ্যতার যদি বিপর্যয়ও হয়, তবে পরবর্তীতে যাতে এই তথ্যভান্ডারটি ব্যবহার করে মানুষের ইতিহাস জানা যায়। আর আমরা কখনোই চাই না, যে মানব জাতি ধ্বংস হয়ে যাক।
অভূতপূর্ব এই প্রযুক্তি যেহেতু উচ্চ সহনশীল(প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায়) তাই জাতীয় সংগ্রহশালা, জাদুঘর, বড় বড় লাইব্রেরিসমুহ তাদের তথ্যসমুহ সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করতে পারবে।
মেক্সিকো'য় আন্তর্জাতিক আলোকবর্ষ(International Year of Light - IYL) এর সমাপনী অনুষ্টানে সার্বজনীন মানবাধিকার ফাইলটি পাঁচমাত্রার ডিস্কে এনকোড করে উপস্থাপন করা হয়েছিল গেল বছর।

কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রনিক্সে ২২ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাশিয়ান বিজ্ঞানী Peter Kazansky উচ্ছাস সহকারে এক সাংবাদিকের কাছে বলেন "এটা আসলেই নাটকীয় যে, আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তথ্য ও দলিলাদি সংরক্ষণের স্থায়ী পদ্ধতি বের করে ফেলেছি। এটা আমাদের মানবজাতির অগ্রগতির ইতিহাসের প্রমাণকে আরো দৃঢ় ও নিরাপদ না করে পারে না।"

আপনাদের জানিয়ে রাখছি, আজই-(১৭ইফেব্রুয়ারী) যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোয় The International Society for Optical Engineering Conference(SPIE) এ ‘5D Data Storage by Ultrafast Laser Writing in Glass’ গবেষণা পত্রটি উপস্থাপন করা হবে। ☺ ☺ 

✒ তথ্যসূত্রঃ
✍ Eternal 5D data storage could record the history of humankind(সাউদাম্পটন ইউনি )
✍ 'Five-dimensional' glass discs can store data for up to 13.8 billion years(দ্য ভার্জ মিডিয়া)
✍ Eternal 5D data storage could record the history of humankind (ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনের অপটোইলেক্ট্রিক রিসার্চ সেন্টার)
✍ This 'Eternal' 5D Storage System Could Record The History Of Our Species(হাফিংটনপোস্ট- ইউকে)
✍ The 'Superman memory crystal' could hold the future of data storage(ম্যাশেবল ব্লগ)
✍ Researchers Raid the Fifth Dimension for ‘Eternal Data Storage’(ওইয়্যার্ড ম্যাগাজিন)
✍ Superman' storage breakthrough could record EVERYTHING humans have created and save it for for billions of years (ডেইলি মেইল অনলাইন)
✍ 5D DVD(উইকিপিডিয়া ইংরেজি)
Share on Google Plus

গেম চেঞ্জার

বাংলাদেশ কে নিয়ে খালি স্বপ্ন দেখি না টুকটাক কাজও করি । মূলত যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ এক সত্ত্বা। ছড়া, কাব্য, গল্পে, ছবি, ভ্রমণে, বিশ্লেষণেও নিজেকে খুঁজে ফিরি।
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 টি তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন