মৃত্যুপথের দিকেঃ মৃত্যুর লড়াই (ভয়গল্প)


পৃথিবীকে যদি একটি ডিম ভাবা হয় তাহলে আমি এখন পৃথিবী নামীয় ডিমের উপরে আছি। ঠিক উপরে না হলেও পৃথিবীর মোট আয়তনের তুলনায় ২-৩% ব্যাবধান ব্যাপার না নিশ্চয়ই। অবশ্য মুল ভুখন্ড ইউরোপ থেকে বিচ্যুত একটি দ্বীপ যাকে আমি স্মোলেন্সক বলে জানি। আন্তর্জাতিকভাবে এটার নাম লিভিংস্টোন আইলেন্ড। এখানে দুঃসাহসী এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ ছাড়া কেউ আসে না। মূল দুনিয়ার মানুষরাও এখানে বসবাস করতে সাহস করে না।



ডিমের উপরিভাগ তথা পুরো দক্ষিণ মেরুর দখলই কিন্তু আমেরিকার সরকারের হাতে। অ্যান্টার্কটিক ট্রিটি সিস্টেমের ঝামেলা পাঁকিয়ে আমরা ৬ জন একটা কপ্টার ভাড়া করে পৌছলাম সকাল ১১ টার দিকে। সকাল ১১টা হলে কি হবে। তাপমাত্রা -১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বুঝেন ঠ্যালা।
আমাদের টিম লিডার মেরি। আমার জানামতে ওর জিওগ্রাফির ওপর দখল ভাল। সে নিজে থেকেই আমাদের জ্ঞান দিতে লাগলো কেন এখানে কেউ থাকে না। কমবেশি মনোযোগ নিয়ে সবাই শুনতে থাকল। শুনবেই বা না কেন মেরির কাছ থেকে কিছু শুনবার জন্য হাভার্ড কেমব্রিজ থেকে শুরু করে বিশ্বের তাবৎ জিওলজিস্টরা সূযোগ খুঁজে। আমাদের সৌভাগ্যই বলতে হবে এই মেডামের এডভেঞ্চারের আগ্রহ ছিল বলেই সেই চান্স হয়েছে কপালে।
বাংলায় একটা কথা আছে "মাগনা(ফ্রি) জিনিসের দাম বাঙালি বুঝে কম" অতএব স্বাভাবিকভাবেই নিজস্ব ভাবনার জগত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হিমাংকের নীচের তাপমাত্রা নিয়ে আমি ভাবতে থাকলাম আমার ফিজিক্সের বিদ্যা নিয়ে। আমি তো আবার ফিজিক্সে মাস্টার্স করেছি। তবে আর যাই হোক মানুষ না থাকার পেছনে ভাল কারন হতে পারে এইটাই, সীমাতিরিক্ত ঠান্ডার ব্যাপারটা। বিধাতা আসলেই এই জায়গাটা মানুষের জ্ঞানার্জনের জন্য বানিয়েছেন বলে ভাবতে থাকলাম।

আমাদের চোখের চারপাশে এখন ধূসর সকালবেলা। দেখতেই লাগছে এই এলাকা ঠান্ডা। কিন্তু এতো ঠান্ডা!! ইসস!
মুখ দিয়ে অজান্তেই এই শব্দ বের হয়ে গেল। সত্যি বলতে কি আমার মনে হচ্ছে যেন দুটি হাতেরই চলৎশক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছে এতো লোমশ জ্যাকেট পরার পরেও। মাংসপেশিগুলোতে প্রবল ব্যাথা অনুভব করলাম।
যাইহোক আমরা পৌছেই ঠান্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য জেনারেটর চালিয়ে দিলাম। লোমশ বেডে শুয়ে কাটালাম ২ ঘন্টা।

এবার ঘুরে দেখার পালা। বের হতেই দেখি ডলফিনের দলের ছুটোছুটি। ওদের যেন মেলা বসেছে আর কি। হুরোহুরি করে ওরা যে যার মত হাঁটাহাটি করছে। একটু দুরে যাওয়ার পর ভয়ে বসে পড়লাম কারন বেশ দুরে বিশাল সাইজের একটি শীল এলিফেন্ট বসা। যদিও ওরা আক্রমণ করে না সহসা তারপরও ভয় ভয় লাগলো। আমাকে দেখে একটা শীল এসে বুঝতে চাইল আমি কি প্রকারের জীব।



ডেভিড ও স্টিফেন আমার কান্ড দেখে হাসতে লাগলো এমনকি গম্ভীর মেরিও। অবশ্য পরক্ষণেই পাল্টে গিয়ে বললো বেশি দেরি করলে ক্যাম্পে ফেরা কষ্টকর হবে কিন্তু। অগত্যা কি আর করা। চললাম।

প্রায় ১ থেকে দেড় মাইল হাঁটার পর আমরা পেয়ে গেলাম কাঙ্খিত সেই লাইডেড চুড়ার উপত্যকাটি। অবশ্য এই চুড়া সম্পর্কে না বললে আপনারা পরে আবার আমাকে দায়ী করে ফেলতে পারেন।



এই রহস্যজনক ও ভয়ানক চুড়াটা নাকি মানুষেরই বানানো। একটি উঁচু টিবি যা দেখতে মোমের মতোই লাগবে ১০-২০ মিটার দূর থেকে। টিবিতে অন্তত ১০ জন মানুষ গোল করে পা ছড়িয়ে বসতে পারবে। গোলগাল। যেসব পদার্থের সাহায্যে গড়া হয়েছে তার মধ্যে নিকেলই বেশি। আরো আছে ক্যাডমিয়াম, সিলভার, আয়রন ও ব্রোঞ্জ। অত্যন্ত শক্ত ও দৃঢ় এই চুড়ায় আজো কেউ পৌঁছাতে সাহস করেনি। ২০০ বছর আগে স্পেনের কর্দোভা থেকে একদল রওয়ানা দিয়েছিল। সংখ্যায় তারা ছিল ২৬ জন। সবাই সমুদ্রে ডুবে মারা গিয়েছিল। এরপর অনেকেই চেষ্টা করেছে কিন্তু প্রাকৃতিক কারণেই শেষ হয়ে গেছে এখানটায় আসার আগে, অনেকে মাঝপথেই। যদিও আমরা এতোটা দূর্ভাগ্যের সম্মুখীন হইনি এখনো।
বিশাল বিশাল আয়তনের বরফের দলার(বৃহৎ খন্ড) নিচে নানারকম পাথর দিয়ে গড়া এই পাহাড়। এর নীচে নাকি হাজার হাজার বছর আগের মানুষদের আটকে রাখা হয়েছে।

আমরা পরিক্ষা করতে লাগলাম দূর্বল পাথরগুলো এই উপত্যকার ঠিক কোন দিকটায় আছে। আমি উঠতে উঠতে বেশ উপরে চলে এসেছি। সবাই পেছনে পড়ে গেছে। একরকম ফাঁকি দেওয়াই বলা যায়। কারন ভাল মতন স্যান্ড টেস্ট না করেই উঠে গেছি। যখন চুড়ার ঠিক ওপরে উঠে যেতে পারলাম তখন চমকে ওঠলাম বললে আসলে ভূল বলা হবে। এইরকম বুক দুরুদুরু নির্জন জায়গায় অন্তত আমি কাউকে আশা করিনি। ভয়ানক আলখেল্লা পরিহিত কাউকে দেখলে আমি না হয়ে অন্য কেউ হলে নির্ঘাৎ মূর্ছা যেত তা না হোক নিজেই আত্মহত্যা করতে চাইত।
বুকের বামপাশে চিনচিনে ব্যাথার একটা স্রোত অনুভব করালাম। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার আশংকা মনে দানা বাঁধল। কনুইয়ের ওপরের বাহু দিয়ে সচেতনভাবে বুকের বামপাশে গূঁতো দিয়ে দিয়ে এটাকে সচল রাখতে চেষ্টা করলাম। আমার কানে হেডফোন লাগান ছিল। ওদের সাথে কথা বলার জন্য হাতের ওয়ারলেস চিপের কথা মনে হলো। কিন্তু কানে কোন রেডিও সিগনালের শব্দ না শুনে আমি কানের শিরার পালস শুনলাম। টিব-টিব, টিব-টিব, টিব-টিব।

লোকটার পরনে জারি মণিমুক্তো খচিত অনেকটা প্রাচীনকালের রাজাবাদশাহ যূগের পোশাক। কানে ইয়া বড় বড় দুল লাগানো। একেকটা দুল এতো বড় যে অনায়েসে হাত ঢুকিয়ে দিতে পারব। অনেকটা হাড়ি তুলে রাখার চিমটার মতোই।
আমাকে হতবম্ভ অবস্থায় দেখে কিম্ভুৎকিমাকার লোকটা প্রণামের মত করে সালাম দিল। আমি বোবার মত যেন বোধ করলাম। কোন শব্দই মুখে আসছে না। আলবৎ আমি কথা বলছি কিন্তু ভোকাল কর্ড থেকে মুখের গহব্বরে পাস হচ্ছে না। বোঁ বোঁ করতে করতে তাঁর দিকে তাকালাম।
তাঁর গায়ের রং কালো শ্যামলা বললে ভুল হবে। তাঁর গায়ের রঙটা অনেকটাই মরক্কোর নাতিসুন্দর যুবকের মত। বুকে ছাতি পড়লো যখন দেখলাম চোখ দুটোর রঙ বর্ণহীন গোত্রের লালচে হয়ে আমার দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। মাথায় একটা সবুজ রঙের কাপড় পেঁচানো। অনেকটা হুজুরদের পাগড়ির মতো। একহাতে খরমের মত একটা (স্যান্ডেল) কাঠের টুকরো। অদ্ভুতাকৃতির গোল তিনটি ছিদ্র করা।
তার পায়ের দিকে চোখ নিয়ে আমার গলায় আর কোন পানি অবশিষ্ট থাকল না। এ তো সাক্ষাৎ জমদূত। ডান পায়ে আঙুল চারটা, বামপায়ে আঙুল ৩টা। কাটাকুটির কোন ব্যাপারও দেখছি না। বুড়ো আঙুলটি নির্বিচার রকমের বিকট। অথচ কৃষ্ণাঙ্গুলটি অবিচার করে যেন ছোট করা। এইরকম অদ্ভুত জীব পৃথিবীতে থাকতে পারে এর আগে আমাকে কেউ বলেনি। শুনাও সম্ভব হয়নি।

আমি চিন্তা করলাম আমি কি মুর্ছা যাবই তাহলে। মাথার লাখ লাখ কোটি কোটি নিউরনগুলো যেন এই বিদঘুটে লোকটা ঝিম করে দিয়েছে। শারীরিক প্রক্রিয়াগুলো একমুহুর্তের জন্য বুঝি পুরোপুরি স্তদ্ধ হয়ে গেল। পাকস্থলিতে কেমন যেন অসাড়তার একটা ভার বহন করতে থাকলাম।
যাই হোক লোকটা দেখি ইংরেজি জানে। সে আমাকে বলল আমি দূর্ভাগা। পৃথিবীর গত ৩০০০ বছরের ইতিহাসের দূর্ভাগা যদি কেউ থেকে থাকে তবে সেটা আমি। আমার সাথে যারা ছিল তাঁরা সৌভাগ্যবান।
আমি কেন যে বলব সেটুকু শক্তিও নেই। লোকটা একা একাই বিড় বিড় করতে লাগল। আসলে বিড় বিড় আমি শুনছি। সে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কথা বলছে। এত জোরে কথা বলছে যে বরফের বিশাল বিশল চাক্কাগুলোও প্রকম্পিত হচ্ছে। মষ্তিষ্কে রক্ত পরিবহন কম হওয়ার ফলে মানুষের ঘুম পায়। আমিও এইভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি।
মষ্তিষ্কে চুড়ান্ত বজ্রপাত হলো যখন লোকটা জানাল আমার সাথে যারা আসছিলেন সবাইকেই সে মেরে ফেলেছে। দুর্বল স্যান্ড পরিক্ষা করতে করতেই ওরা সবাই অক্ষা গেছে। উপর থেকে বড় বড় পাথরের চাপায়।

আমার চোখের পাশে ফোলা ফোলা অনুভব করলাম যখন দেখলাম লোকটা আমার মুখ থেকে কোন প্রকারের শব্দ অনুচ্চারিত সত্তেও সে আমার কথা বুঝতে পারছে। আমার মাথায় যখন অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তখন তাঁর ভয়ানক হার্মাদি কন্ঠেই জানাল-
আমার নাম সামুত। আমি হিংসুটে, বিশৃংখল ও নৃশংস মানব জাতির অন্তর্গত নই। আমি এই পাহাড়ের নিরাপত্তা বিধান করি। আমি আপনার প্রশ্ন/কথা নিজে থেকেই বুঝতে পারি। আপনার মনের ইচ্ছা ছিল এই পাহাড়ের চুড়ায় ওঠা। এখনো পূর্ণ হয়নি আর এই মুহুর্তে আমার হাত থেকে আপনি পালাতে চাইছেন। কিন্তু পারবেন না। যতই চেষ্টা করেন আমাদের হাত থেকে আপনার নিস্তার নেই। আপনার মৃত্যু নিশ্চিত এটা আমি জানি। শুনুন! আপনার মরণ হবে সবচেয়ে কষ্টের গত ৩০০০ বছরের মধ্যে যত মানুষ জন্ম নিয়েছিল তাদের মধ্যে। "
(চলবে)
Share on Google Plus

গেম চেঞ্জার

বাংলাদেশ কে নিয়ে খালি স্বপ্ন দেখি না টুকটাক কাজও করি । মূলত যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ এক সত্ত্বা। ছড়া, কাব্য, গল্পে, ছবি, ভ্রমণে, বিশ্লেষণেও নিজেকে খুঁজে ফিরি।
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 টি তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন